উত্তরবঙ্গ নিউজ : জলপাইগুড়ি : ধূপগুড়ি-ময়নাগুড়ি : ৩ রা এপ্রিল ২০২২ : রবিবার : জন্মের পর থেকে আমৃত্যু কেউ সুখে বসবাস করেন, আবার কাউকে সারা জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। তাদের জীবনের সংগ্রাম যেন শেষ হয় না। এমনই এক সংগ্রামী উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী পাপ্পু। আসলে প্রকৃতি যখন করো বিপরীতে দাঁড়ায় তখন জীবনে বেঁচে থাকার জন্য সহস্র সংগ্রাম করতে হয়, এমন লড়াইকে সামনে রেখে ধূপগুড়ির উত্তর আলতাগ্রাম মধ্যপাড়ার পাপ্পু আজ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। জন্ম থেকে যার উচ্চতা দেড় ফুট। শুধু তাই নয়, কোমড় থেকে পা পর্যন্ত আড়ষ্ট, চলাফেরা করতে পারে না। চলাফেরা করার জন্য ভরসা মা কিংবা বাবার কোল। তবে বয়সের ভাঁড়ের থেকে ছেলের ভাঁড়ের বেশি গুরুত্ব পাপ্পুর বাবা বিশ্বনাথ রায়ের ও মা রেনুকা রায়ের কাছে।
জানা গেছে, পাপ্পুর বাবা বিশ্বনাথ রায় পেশায় একজন দিন মজুর। দুই ছেলের মধ্যে পাপ্পু বড়। ছোট ছেলে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছে। জন্মের পর পাপ্পুকে নিয়ে দুঃচিন্তায় পড়েছিল অভিভাবকরা। তার ভবিষ্যৎ কি হবে, এই নিয়ে দুঃচিন্তায় কালোমেঘ ঘনিয়ে এসেছিল পাপ্পুর বাবার। তবে প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময়েই পাপ্পু তার প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিল। এরপর কালীরহাট দেওয়ান চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করে। সেখান থেকে ৫০% নম্বর নিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করে ঐ স্কুলেই কলা বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয় পাপ্পু। পাপ্পুকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, বাড়ি নিয়ে আসা নিয়ে সমস্যায় পড়ে বাবা-মা। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ১০ কিলোমিটারের মতো। পাপ্পুতো একাই কোথাও যেতে পারে না, দিন রাত পিঠে বালিশ নিয়ে বসে থাকতে হয়। অপরদিকে বিশ্বনাথ বাবুর দিন মজুরী না করলে ঘরে হাঁড়ি চড়বে না। তাই তার মা ফাইভ থেকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া আনা করত। তখন তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় কালীরহাট স্কুলের শিক্ষকরা। তারা পাপ্পুর এই পরিস্থিতি দেখে নিয়মিত সাহায্য করত। এই নিয়ে কালীরহাট স্কুলের প্রধান শিক্ষক পঙ্কজ অধিকারী বলেন, পাপ্পু মাধ্যমিক খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। তবে শুধু ভালো রেজাল্ট করাটা বড় কথা নয়, পাপ্পুর মতো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলের এরকম জীবন সংগ্রাম এবং তার বাবা-মা এর যা অবদান তা এক কথায় আমাদের গর্বিত করে। পাপ্পুর উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট সহ প্রশাসনের সহযোগিতার আশাবাদী তিনি।
এদিন দেখা গেল, বাবা সাইকেল চালিয়ে এবং মা পাপ্পুকে কোলে নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্রে এসেছেন। স্কুলে সে রকম পরিকাঠামো না থাকার কারণে পিঠে বালিশ রেখে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে দেখা গেছে পাপ্পুকে। তবে তার পরিবারের অভিযোগ, পাপ্পুর জন্য বাড়িতে বসার মতো কোনো চেয়ার নেই। মাসে সম্বল ১০০০ টাকার মানবিক ভাতা। এছাড়া আর কোনো সরকারি সুযোগ সুবিধা জোটেনি। অথচ এলাকায় মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত পাপ্পু। একবার পড়লে পড়া মুখস্থ হয়ে যায়। ভবিষ্যতে কলেজে পড়ে শিক্ষকতা করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছে পাপ্পু। পাপ্পু জানায়, উচ্চ মাধ্যমিকের পর কলেজে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করে স্কুলে শিক্ষকতা করতে চায়। তবে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত পাপ্পুর বাবা বিশ্বনাথ রায়। তিনি বলেন, খুব কষ্ট করে পাপ্পুকে পড়াচ্ছি। দিন-আনা দিন-খাওয়া সংসার। একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলে ভাল হয়। তবে পাপ্পুর জীবন যুদ্ধে সারা জীবন পাশে থাকতে চান বলে জানান পাপ্পুর মা। তিনি বলেন, আমি আমার ছেলেকে মানুষ করে দেখিয়ে দিতে চাই পাপ্পুর মতো বিশেষ চাহিদা সম্পন্নরাও সব পারে। তেমনি পাপ্পু একদিন ভালো জায়গায় পৌছাবে এই আশা রেখেছেন কালীরহাট দেওয়ান চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও।